বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা: (Vedic literature).


'বিদ' শব্দ থেকে বেদ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হল জ্ঞান। হিন্দুদের মতে বেদ নিত্য ও অপৌরুষেয়। বেদের অপর নাম 'শ্রুতি'।

বেদ সম্পর্কিত সকল সাহিত্যকেই 'বৈদিক  সাহিত্য' বলা হয়।

বৈদিক সাহিত্য দুই ভাগে বিভক্ত, যথা—
  •  শ্রুতি।
  •  স্মৃতি।

----- শ্রুতি -----

বেদ চার ভাগের বিভক্ত, যথা—
  •  ঋগবেদ।
  •  সামবেদ।
  •  যজুর্বেদ।
  •  অথর্ব বেদ। 

প্রতিটি বেদ চারটি অংশে বিভক্ত, যথা—
সংহিতা: ঋগবেদের সংহিতাতে দেবতাদের স্তব ও প্রার্থনা আছে।

ব্রাহ্মণ: যাগ-যজ্ঞের বিধি-নিষেধে। এটি গদ্যে লেখা।
সাত ধরনের ব্রাহ্মণের কথা উল্লেখ আছে, যথা—
  •  আইত্রয়া এবং কৌশটিকি (ঋগবেদ)।
  •  পঞ্চভীষা, সদাভিয়া, যামিনী— (সামবেদ)।
  •  সৎপথ— প্রাচীন ও বৃহত্তম, (যজুর্বেদ)।
  •  গোপথ (অথর্ব বেদ)।

আরণ্যক: অরণ্য সম্পর্কিত (Forest Book) বৃদ্ধ বয়সে অরণ্যবাসীর ধর্ম-জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় তত্ত্ব। একে বৈদিক সাহিত্যের মূল অংশও বলা হয়। বানপ্রস্থ জীবনের কর্তব্য সম্পর্কে লিখিত আছে।

উপনিষদ: উপনিষদ (Philosophy of Hindu Religion)— হিন্দুধর্মের দর্শন) উপনিষদ শব্দটি এসেছে 'উপ এবং যদ' থেকে যার অর্থ ‘পাশে বসা’ (Seat near by or Seat aside)

উপনিষদ তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত—
  •  কর্ম।
  •  আত্মা।
  •  ব্রহ্ম।
উপনিষদ বেদান্ত নামে পরিচিত কারণ এটি বেদের শেষ ভাগ।

উপনিষদ প্রথম ইংরাজীতে অনুবাদ করেন, চার্লস উইলকিনস্ (গীতারও ইংরাজী অনুবাদক তিনি)।

'সত্যমেব জয়তে' অর্থাৎ সত্যের জয় হোক কথাটি মুণ্ডক উপনিষদ থেকে নেওয়া।

সর্বমোট ২০০টি উপনিষদের খোঁজ পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এবং ১০৮টি উপনিষদ ৮০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত।

উপনিষদের বিষয় ছিল 'আন' (Auman Self) এবং 'ব্রাহ্মণ' (Brahman Absolute being) এই দুটি বিষয় নিয়ে।
অন্যতম বড় উপনিষদ Chhandogya যাতে তিনটি আশ্রম যথা ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ

দুই প্রকার বিবাহ সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
  •  অনুলোম।
  •  প্রতিলোম।

ভারতবর্ষের প্রাপ্ত ১০৮টি উপনিষদের মধ্যে ১২টি উপনিষদ খুব গুরুত্বপূর্ণ এগুলি হল:
  1.  ঐতেরীয়।
  2.  কৌশিটাকী।
  3.  ছান্দোগ্য।
  4.  কেন।
  5.  তৈত্তেরীয়।
  6.  কথা।
  7.  শ্বেতস্বরো।
  8.  বৃহদারণ্যক।
  9.  ঈশ।
  10.  মুণ্ডক।
  11.  প্রশ্ন।
  12.  মাণ্ডুক্ক।

আরণ্যকের দার্শনিক তত্ত্ব পরিণীতি পেয়েছে উপনিষদে।


---- স্মৃতি ----
বেদাঙ্গ:
বেদাঙ্গ সূত্র আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সুত্র হল ছোট আকারের ঘনীভূত বক্তব্য সমূহ।

ছয় রকমের বেদাঙ্গ হল:—
শিক্ষা বিশুদ্ধ উচ্চারণ।
ছন্দ বেদের ছন্দ সম্পর্কিত।
ব্যাকরণ— ভাষা ব্যবহারের নিয়ম।
নিরুক্ত শব্দের উৎপত্তির ব্যাখ্যা।
জ্যোতিষ গ্রহ নক্ষত্রাদি সম্বন্ধে।
কল্প যাগযজ্ঞের বিধান।

স্মৃতি:
ছয় রকমের স্মৃতি আছে, যথা—
  •  মনু স্মৃতি।
  •  নারদ স্মৃতি।
  •  যাজ্ঞবল্ক।
  •  বৃহস্পতি।
  •  পরাশর।
  •  কাত্যায়না।

মহাকাব্য(Epic):
রামায়ণ, মহাভারত।

পুরাণ:
পুরাণ ১৮টি। মৎস্য পুরাণ সবচেয়ে প্রাচীনতম।

উপবেদ:
চার ধরনের উপবেদ আছে, যথা—
আয়ুর্বেদ— Medical Science নিয়ে (ঋগবেদ)।
ধনুর্বেদ— যুদ্ধবিদ্যা (যজুর্বেদ)।
গান্ধর্ববেদ– Music বা সঙ্গীত (সামবেদ)।
শিল্পবেদ— Art & Architecture (অথর্ববেদ)।

দর্শন:
দর্শন শাস্ত্রের ছটি অংশ রচনা করেছেন ছয়জন দার্শনিক।

ন্যায়দর্শন— (গৌতম মুনি)।
বৈশেষিক দর্শন— (ঋষি কণাদ)।
সাংখ্য দর্শন কপিল মুনি(প্রাচীনতম)।
পূর্বমীমাংসা দর্শন (জামিনী বা জৈমিন)।
যোগ দর্শন পতঞ্জলি।
উত্তর মীমাংসা দর্শন বেদব্যাস (মহাভারতের রচয়িতা)।

কল্পসূত্র:
কল্পসূত্র তিনটি ভাগে বিভক্ত, যথা—
  •  Shrauta Sutra: concerned with vedic sacrifices.
  •  Grihaya Sutra: concerned with comparitively simpler domestic sacrifices এদের মধ্যে উপনয়ন, বিবাহ, অন্ত্যোষ্টিও ছিল।
  •  Dharma Sutra: concerned with the rituals Dharma.

----- ঋগবেদ -----
ঋগবেদ ভারত তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য।
  • ১৪০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বের মধ্যে সরস্বতী নদীর তীরে এটি রচিত হয়েছিল। 
  • ঋগ্বেদের মোট ১০২৮টি শ্লোক বা স্তোত্র ছিল। 
  • ঋগ্বেদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গায়ত্রী মন্ত্র যা সাবিত্রীর উদ্দেশে পাঠ করা হত। 
  • ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলি দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
  • সর্বোচ্চ ২৮৯টি স্তোত্র নিবেদিত হয়েছে ঋগবেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রশংসিত দেবতা ইন্দ্রের নামে। তিনি ছিলেন স্বর্গের অধীশ্বর এবং বজ্র ও বিদ্যুতের দেবতা বরুণ ছিলেন (Rita Cosmic order) বিশ্বের সৃষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ের অধিষ্ঠাত্র দেবতা। 
  • বেদে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সরস্বতী নদীর নাম। পূর্বে যমুনা ও পশ্চিমে শত নদীর মধ্যবর্তী স্থানে সরস্বতী নদীর কথা আলোচিত হয়েছে।

ঋগবেদে উল্লিখিত সপ্তসিদ্ধ নদীগুলি হল- 
সিন্ধু, সরস্বতী, শতদ্রু (সুরুঞ্জি), পুরুষাণি (রাভি বা ইরাবতী), আসিকানি (চেনার), বিপাশা (বিপাস), ও বিতস্তা।

  • ঋগবেদ আবৃত্তিকারীদের বলা হত হোত্রী।
  • পুরোহিতদের বলা হত 'Kotri' or 'Motri'.
  • ঋগবেদ (ওম শব্দটি) সবচেয়ে বেশী বার উচ্চারিত হয়েছে মোট ১০২৮ বার।
  • ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তে জাতিপ্রথার অর্থাৎ বর্ণপ্রথার উল্লেখ আছে।
  • এটি একটি মনোলিথিক পাঠ্য
  • দ্বিতীয় থেকে সপ্তম পর্যন্ত প্রাচীনতম মন্ডলগুলিকে পারিবারিক বই বলা হয় কারণ সেগুলি শ্রেষ্টঋষিদের বিশেষ পরিবারের জন্য দায়ী।
  • মন্ডল অষ্টম - বেশিরভাগই  কাণ্ব পরিবারের সাথে সম্পর্কিত।
  • নবম মন্ডল - সোম স্তোত্রের সংকলন।
  • ঋকবেদের সপ্তম মণ্ডলে উল্লেখ আছে, ভরত গোষ্ঠীভুক্ত রাজা সুদাসের সঙ্গে দশরাজার যুদ্ধ হয় পুরুষানি বা রাভি নদীর তীরে। যুদ্ধে রাজা সুদাস জয়ী হন।

----- সামবেদ -----
  • সামবেদ সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা। দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তুতি জ্ঞাপনের গীতিমন্ত্র। ১৮১০ টি স্তোত্র ছিল। 
  • স্তোত্রগুলি পূজা ও যজ্ঞে সুর করে গাওয়া হত।
  • সামবেদ পাঠকারীদের বলা হত উদগাত্রী।
  • পদ রাগ সামবেদে ছিল (এটি গেয়েছিল তানসেন)।
  • সামবেদের উপবেদ ছিল গান্ধাববেন।

সামবেদের শাখাগুলি হল–
  • Kauthuma.
  • Jaiminiya (Talavakara).
  • Ranayania.

----- যজুর্বেদ -----
  • যজুর্বেদে ১৫৪৯ টি স্তোত্র ছিল।
যর্জুবেদের দুইটি ভাগছিল, যথা—
  •  Shukla Yajurveda (contains only Mantras )
  •  Krishna Yajurveda (contains prose and Mantras )

  • যজুর্বেদ পাঠকারীদের বলা হত উদভায়।
  • Sacrificial prayer বা 'উৎসর্গের প্রার্থনা' নামেও পরিচিত ছিল।
  • শতপথ ব্রাহ্মণ মজুর্বেদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।

----- অথর্ববেদ -----
  • অথর্ববেদে ৭৩১ থেকে ৭১১টি স্তোত্র ছিল। 
  • এখানে অনার্যদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 
  • ভারতীয় যাদুবিদ্যা, তুকতাক - সব অর্ববেদের অংশ। (মায়াবিদ্যা)।
  • এটি ছিল শেষ বেদ এবং ২০টি কান্ডেতে বিভক্ত ছিল, এবং এটিতে গোপথ ব্রাহ্মণ অর্ন্তভূক্ত ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা: (Vedic literature)."