স্বাধীনতার সংজ্ঞা | স্বাধীনতার প্রকারভেদ বা বিভিন্ন রূপ | স্বাধীনতার রক্ষাকবচ:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্বাধীনতা শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Liberty ল্যাটিন শব্দ Liber থেকে গৃহীত, যা Libertinus হতে উদ্ভূত। এর অর্থ a freed man বা মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস। আবার স্বাধীন শব্দটি ভাঙলে স্ব+অধীন পাওয়া যায়। অর্থাৎ নিজের অধীনে থাকার নামই স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা:সাধারণত অপরের কাজে কোনােরূপ হস্তক্ষেপ না করে নিজের কাজ সম্পাদন করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা হলাে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভােগ করা। সুতরাং বলা যায়, অপরের অধিকার বা কার্যাবলির ওপর হস্তক্ষেপ না করে স্ব-ইচ্ছানুসারে কার্য করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কতিপয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলাে-
হার্বার্ট স্পেন্সর (Herbert Spencer) বলেন, 'স্বাধীনতা বলতে খুশিমত কাজ করা বুঝায়, যদি উক্ত কাজ দ্বারা অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভােগে বাধার সৃষ্টি না হয়।'
টি এইচ গ্রিন (T. H. Green) বলেন, যা উপভােগ করার এবং সম্পন্ন করার যােগ্যতা উপভােগ ও সম্পাদন করার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলি (Seely)-এর মতে, অতি শাসনের বিপরীত ব্যবস্থাই হলাে স্বাধীনতা। (The opposite of over government).
আর্নেস্ট বাকার (Ernest Barker)-এর মতে, 'প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সকলের স্বাধীনতা প্রয়ােজনের দ্বারা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ্যক।'
প্রফেসার গেটেল (Prof. Gettel) বলেন, 'স্বাধীনতা হচ্ছে সেসব কাজ করা এবং উপভােগ করা যেগুলাে করা ও উপভােগ করার যােগ্য।'
সি, ডি, বার্নস (c.D. Burns)-এর মতে, Liberty means liberty to grow to ones natural hight, to develop ones, abilities. অর্থাৎ স্বাধীনতা হলাে ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশ। ব্যক্তির সামর্থ্যের উন্নয়ন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্বাধীনতা সম্পর্কে একটি সহজবোধ্য সাধারণ সংজ্ঞা দেওয়া যেতেই পারে। স্বাধীনতা হল শ্রেষ্ঠ এবং সংরক্ষিত এমন এক পরিবেশ যেখানে শর্তসাপেক্ষে আইন অনুসারে সব মানুষ আত্মবিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে, এক্ষেত্রে অধিকার হলো স্বাধীনতার ভিত্তি।
স্বাধীনতার প্রকারভেদ বা বিভিন্ন রূপ:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতার প্রকৃতি আলোচনায় স্বাধীনতাকে বিভিন্ন রূপে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার রূপগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—
প্রাকৃতিক স্বাধীনতা:
রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার আগে মানুষ যে প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত এবং স্বাধীনতা ভোগ করত তাকেই প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বলে। এ প্রসঙ্গে রুশো বলেছেন, মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সে চারিদিক থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ। প্রকৃতির রাজ্যে যে স্বাধীনতার কথা বলা হয় তা কেবল কল্পনামাত্র।
পৌর স্বাধীনতা:
সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সমাজ-জীবনের সুখসমৃদ্ধির স্বার্থে কতকগুলি অধিকার অপরিহার্য। এই অধিকারগুলিকে পৌর অধিকার বলে। দৃষ্টান্ত হিসাবে জীবনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সকল অধিকারের অস্তিত্ব ছাড়া মানুষের সমাজ-জীবন সার্থক হতে পারে না।
সামাজিক স্বাধীনতা:
সমাজ ও রাষ্ট্র এক নয়। মানুষের সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মধ্যে পার্থক্য থাকে। মানুষ তার সামাজিক জীবনে যে স্বাধীনতা ভোগ করে তাকে সামাজিক স্বাধীনতা বলে। বর্তমানে সামাজিক স্বাধীনতা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়।
জাতীয় স্বাধীনতা:
স্বাধীন দেশই কেবল নাগরিকদের সকল প্রকার স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। জাতীয় স্বাধীনতা ছাড়া অন্যান্য স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। স্বাধীনতা বলতে অপর রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি বোঝায়। ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা:
প্রাচীনকালে গ্রিকরা ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত স্বাধীনতার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। এথেন্সের অধিবাসীরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে স্বশাসন, প্রাত্যহিক অভাবঅভিযোগ থেকে মুক্তি এবং ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার স্বার্থে বাহ্যিক আচার-আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতিকে বোঝাতেন। এথেন্সবাসীদের সম্প্রদায়গত স্বাধীনতার ধারণা এখনকার জাতীয় স্বাধীনতার ধারণার অনুরূপ ছিল।
আইনসংগত স্বাধীনতা:
আইনসংগত স্বাধীনতা বলতে, রাষ্ট্রকর্তৃক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বোঝায়। এই স্বাধীনতা সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত। বৃহত্তম স্বার্থে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে সকলের স্বাধীনতার উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ:
ব্যক্তিস্বাধীনতার যথাযথ সংরক্ষণের জন্য স্বাধীনতার রক্ষাকবচ প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হল স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা। তাই বর্তমান রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে যে যে ব্যবস্থার উপর প্রাধান্য আরোপ করা হয়। সেগুলি হল—
লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার:
সংবিধানের মৌলিক অধিকার সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে গণ্য হয়। সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি সুস্পষ্ট ও লিপিবদ্ধ থাকলে সাধারণ নাগরিক সেই সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার ঘটলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা হয়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ:
স্বাধীনতার আর-একটি রক্ষাকবচ হল ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ। এ প্রসঙ্গে মতেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা বলেছেন। এই নীতির প্রবক্তাদের মতে, সরকারের সমস্ত ক্ষমতা যদি একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে স্বৈরাচারিতা সৃষ্টি হয়, ফলে স্বাধীনতা ব্যাহত হয়।
আইনের অনুশাসন:
আইনের অনুশাসন বলতে বোঝায়—
- আইনের পরিপূর্ণ প্রাধান্য।
- আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে সরকার প্রচলিত আইন অনুযায়ী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
গণভোট, গণউদ্যোগ ও পদচ্যুতি বা প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা:
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে গণ্য হয়। নাগরিকগণ মূলত এইসকল পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার বা জনগণের প্রতিনিধিরা কোনো অন্যায় করলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারে।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ:
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হলে জনগণের স্বাধীনতা ভোগে প্রতিবন্ধকতা কম থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলির তাৎপর্য এককভাবে নয়, এগুলির মিলিত অবস্থানের ভিত্তিতেই স্বাধীনতার প্রকৃত পরিবেশ গড়ে ওঠে। কারণ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণ সচেতন সতর্ক, সচেষ্ট না হলে নিছক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "স্বাধীনতার সংজ্ঞা | স্বাধীনতার প্রকারভেদ বা বিভিন্ন রূপ | স্বাধীনতার রক্ষাকবচ:"