সুলতানি আমলের ইক্তা ব্যবস্থা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। (Iqta System).


দিল্লির সুলতানি শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তাদারদের দ্বারা পরিচালিত ইক্তা প্রথা। ইক্তা গ্রহণকারীরা 'মাকতি' বা 'ইক্তাদার' নামে পরিচিত ছিল। ‘ইক্তা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল একটি অংশ বা এলাকা। রাজস্ব ব্যবস্থার বিচারে ইক্তা শব্দের সহজ অর্থ হল ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্যের ওপর বিশেষ কোনাে ব্যক্তিবর্গকে সরকার কর্তৃক অধিকারদান।

ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন:
ইক্তা ব্যবস্থা ইসলামীয় জগতে প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে তুর্কিরা এই ব্যবস্থা ভারতে আমদানি করে। ভারতে ত্রয়ােদশ শতকের সূচনা পর্বে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ইক্তা প্রথার প্রবর্তন করেন।

ইক্তার প্রকারভেদ:
সুলতানি যুগের ভূমি বন্দোবস্তে জমিগুলিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-

  •  খালিসা অর্থাৎ সুলতানের খাসজমি: জমির রাজস্বের সমস্ত অংশ জমা দিতে হত রাজকোশে।
  •  খালসা বহির্ভূত জমি: খালসা জমির বাইরে যে জমি ছিল তা নির্দিষ্ট শর্ত ও কর্তব্য পালনের বিনিময়ে সুলতান তার সেনাধ্যক্ষ, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যে তাদের মর্যাদা অনুসারে বন্টন করে দিতেন, এই প্রথা কে ইক্তা প্রথা বলা হয়। 

ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যসমূহ:
  •  দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সুবিশাল বিস্তৃতির কারণে দূরবর্তী অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে সুলতানরা ইক্তাদার নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
  •  তুর্কি আমির বা অভিজাতরা দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা যাতে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারেন, তাই তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।
  •  এ ছাড়া দূরবর্তী অঞ্চলগুলি থেকে সঠিক সময়ে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার জন্য এবং উক্ত অঞ্চলগুলিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইক্কা প্রথা প্রবর্তনের উদ্যোগ গৃহীত হয়।

ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
ইক্তাদার তাঁর প্রাপ্ত ইক্তা থেকে রাজস্ব আদায় ও ভােগ দখলের বিনিময়ে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকতেন। যেমন—

  •  সুলতানের প্রয়ােজনের সময় ইক্তাদার সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতেন।
  •  নির্দিষ্ট ইক্তা এলাকায় ইক্তাদারকে আইন-শৃঙ্খলা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হত।
  •  ইক্তাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্য রাজস্ব বা কর ইক্তাদারদের আদায় করতে হত।আদায়কৃত রাজস্ব থেকে নিজ ব্যয় বাবদ অর্থ বাদ দিয়ে উদবৃত্ত অর্থ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিতে হত।

ইক্তা ব্যবস্থার সংস্কার ও বিবর্তন:
সুলতান ইত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ থেকে বিভিন্ন সময়ে এই প্রথার সংস্কার ও বিবর্তন ঘটে। যেমন –

ইলতুৎমিসের আমল:
ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের পর সুলতান ইলতুৎমিস তাকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন। কোনাে ইক্তার ওপর বংশানুক্রমিক অধিকার যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য তিনি ইক্তাদারদের বদলির নীতি নেন।

বলবনের আমল:
বলবনের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়। যে সমস্ত ইক্তাদার ভাতা ও জমি ভােগদখল করলেও প্রয়ােজনের সময় সামরিক সাহায্য দিতেন না, বলবন তাদের তালিকা তৈরি করান। ইক্তাদাররা যাতে সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে, তার জন্য বলবন প্রতিটি ইক্তায় খােয়াজা নামে এক ধরনের হিসাবপরীক্ষক নিয়ােগ করেন।

আলাউদ্দিন খলজির আমল:
আলাউদ্দিন খলজির আমলে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে ইক্তা ব্যবস্থাতে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। তিনি দিল্লি থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে ইক্তা ব্যবস্থা বজায় রাখেন এবং নিকটবর্তী অঞ্চল গুলির জমি খালিসা জমিতে পরিণত করেন। তিনি সেনাদের ইক্তাদানের পরিবর্তে নগদ বেবতনদানের প্রথা চালু করেন।

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল:
মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। তিনি সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানেইচ্ছুক ব্যক্তিকে ইক্তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। তিনি সেনাদের নগদ বেতন দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন।

ফিরোজশাহ তুঘলকের আমল:
ফিরােজশাহ তুঘলক ব্যাপকভাবে ইক্তা বিতরণ করলে খালিসা জমির পরিমাণ কমে। তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে বংশানুক্রমিক করে দেন।

     সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনের মূল ভিত্তি ছিল ইক্তা ব্যবস্থা। সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় সুলতানি সাম্রাজ্যের ভালাে-মন্দের দায়-দায়িত্ব এই ইক্তাদারদের ওপরই নির্ভর করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "সুলতানি আমলের ইক্তা ব্যবস্থা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। (Iqta System)."