ভারতীয় অর্থনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কীরূপ প্রভাব পড়েছিল? অথবা, ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল? Economic impact of World War I on India.
ভূমিকা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) ছিল বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা প্রায় সমস্ত দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছিল। যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল গ্রেট ব্রিটেন। ব্রিটিশ ভারতের মতো উপনিবেশও এই যুদ্ধে জড়িত হয় এবং ‘যুদ্ধরত দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতবাসী অর্থ, সম্পদ, সৈন্য ও রসদ সরবরাহের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ ভারতের অর্থনীতির উপর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারতের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক ও শিল্পপতি সবাই বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারতীয় অর্থনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান প্রভাবসমূহ:
অতিরিক্ত ব্যয় ও ঋণ বৃদ্ধি:
ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে ভারতের ওপর ঋণ চাপায়। জাতীয় ঋণ প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পায়। সামরিক খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ চলতে থাকে, যা যুদ্ধ শেষে ও কিছু সময় ধরে অব্যাহত থাকে। এতে ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত হয়।
করের বোঝা বৃদ্ধি:
যুদ্ধকালীন ব্যয় মেটাতে আয়কর ও ভূমি রাজস্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯১১-১২ সালে আয়কর ছিল রাজস্বের মাত্র ২%, যা ১৯১৯-২০ সালে বেড়ে ১১.৭৫% হয়। ধনী ও দরিদ্র উভয়ের উপরই করের বোঝা চাপানো হয়। কৃষকরা নিয়মিত রাজস্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত উপকর দিতে বাধ্য হয়।
মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি:
অতিরিক্ত কাগজের মুদ্রা ছাপার ফলে বাজারে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। মজুতদারি ও কালোবাজারির কারণে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খাদ্য সংকট:
ভারতীয় সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহের জন্য প্রচুর খাদ্যশস্য বিদেশে পাঠানো হয়। একই সময়ে গ্রামীণ অঞ্চলের কৃষক পরিবারকে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে বাধ্য করা হয়। ফলে দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয় এবং কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
কৃষকের দুরবস্থা:
যুদ্ধের সময় পাট, বস্ত্র ও পশমের চাহিদা বেড়েছিল, কিন্তু কৃষকরা তার সুবিধা পাননি। অতিরিক্ত কর, জমি থেকে উচ্ছেদ এবং ভূস্বামীদের শোষণ তাদের আর্থিক দুরাবস্থা আরও বাড়ায়।
শিল্প ও বণিকদের প্রভাব:
যুদ্ধকালীন সময়ে ইংল্যান্ড থেকে শিল্পপণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় ভারতের শিল্পে সাময়িক অগ্রগতি দেখা দেয়। নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরনো কারখানার আধুনিকীকরণ হয়। তবে যুদ্ধশেষে ব্রিটিশ আমদানি পুনরায় শুরু হলে দেশীয় শিল্প সংকটে পড়ে।
শ্রমিক অসন্তোষ ও ছাঁটাই:
মজুরি সামান্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু খাদ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেক বেশি। ফলে শ্রমিকদের জীবনমান খারাপ হয়। কলকারখানায় ছাঁটাই ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরু হয়।
উপসংহার:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের অর্থনীতিকে বহুমুখীভাবে দুর্বল করে দেয়। ঋণভার বৃদ্ধি, করের বোঝা, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট, কৃষক ও শ্রমিকদের দুরাবস্থা এবং শিল্পে মন্দার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে যায় এবং দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশ স্থগিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের অর্থনীতি ও সমাজকে এমন একটি অবস্থায় পৌঁছে দেয় যা পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলে।



Post Comment