সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ: প্রতিষ্ঠা, লক্ষ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব: All India Muslim League: Establishment, Aims and Historical Significance.
ভূমিকা:
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুসলমান সমাজ রাজনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল। সেই সময় তাদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর প্রাসাদে “সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলে, একইসঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গতিপথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। একটি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার মাধ্যমে এটি পরবর্তীকালে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা নেয়।
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা:
৩০ ডিসেম্বর, ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহ, আগা খান, নওয়াব মোহসিনুল মুলক, ও করাচির মুহাম্মদ আলি প্রমুখ নেতাদের উদ্যোগে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ (All India Muslim League) গঠিত হয়। ঢাকার শাহবাগ প্রাসাদে অনুষ্ঠিত মহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের সভায় এই সংগঠন জন্ম লাভ করে।
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার পটভূমি বা প্রেক্ষাপট:
ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব:
১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পর মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসকদের চোখে অবিশ্বস্ত বলে গণ্য হয়। ফলে প্রশাসন, শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা মুসলমান সমাজে এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রেরণা দেয়।
আলীগড় আন্দোলন ও স্যার সৈয়দ আহমদের ভূমিকা:
স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে মোহাম্মদান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের উচিত সরকারের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা গঠন করা। তাঁর এই চিন্তাই মুসলিম লীগের আদর্শিক ভিত্তি গড়ে দেয়।
বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়া:
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ নীতি (১৯০৫) পূর্ববঙ্গে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি প্রদেশ সৃষ্টি করে। হিন্দু সমাজ এর বিরোধিতা করলেও মুসলমানরা একে স্বাগত জানায়। হিন্দু সমাজের প্রতিবাদ মুসলমানদের মনে রাজনৈতিক অবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে আলাদা সংগঠনের আকাঙ্ক্ষা জন্ম দেয়।
ইংরেজদের বিভাজননীতি:
ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের প্রভাব কমানোর জন্য ‘Divide and Rule’ নীতি গ্রহণ করে। তারা মুসলমান নেতাদের উৎসাহ দেয় নিজেদের আলাদা সংগঠন গঠনের জন্য। এই প্রকার সরকারি উৎসাহেই মুসলিম লীগের জন্ম সম্ভব হয়।
শিক্ষিত ও অভিজাত মুসলমান শ্রেণির স্বার্থরক্ষা:
মুসলমান জমিদার ও অভিজাত শ্রেণি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয় অনুভব করে। তারা মনে করে, কংগ্রেসের আওতায় তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। তাই তারা আলাদা সংগঠন গঠনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করতে চায়।
নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্ব:
ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম রাজনীতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার নবাববাড়িতে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের অধিবেশনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় এই সংগঠন কাজ করবে।
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের মূল লক্ষ্য ছিল—
- ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের অনুগত রাখা।
- মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা।
- কংগ্রেসের প্রভাব থেকে মুসলমান সমাজকে আলাদা রাখা।
- সরকার ও মুসলমানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
মুসলিম লীগের কার্যকলাপ:
- প্রথমদিকে লীগ ছিল ব্রিটিশপন্থী; তারা স্বাধীনতার বদলে মুসলমানদের জন্য প্রশাসনিক সুযোগ ও চাকরির দাবি জানাত।
- ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার-এর মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনী আসন (Separate Electorate) ব্যবস্থা চালু হয়, যা লীগের অন্যতম বড় সাফল্য ছিল।
- পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে লীগ স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলে।
- ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো “পাকিস্তান” নামক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা প্রকাশ পায়।
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের গুরুত্ব:
১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রথমে এটি মুসলমান সমাজের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত হলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গতিপথে গভীর প্রভাব ফেলে। মুসলিম লীগের ভূমিকা শুধু মুসলমান সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না — এর কার্যকলাপ ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভাগ্যও নির্ধারণ করে দেয়।
মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি:
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ভারতের মুসলমান সমাজ রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল।
লীগের প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগিয়ে তোলে। তারা বুঝতে পারে যে, নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। ফলে মুসলমানরা শিক্ষা, প্রশাসন ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হয়।
মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার সংগঠন:
মুসলিম লীগ ছিল মুসলমান সমাজের প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন।
এর মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের দাবি ও স্বার্থ ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
বিশেষ করে মর্লে-মিন্টো সংস্কার (১৯০৯) অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনী আসন (Separate Electorate) ব্যবস্থা চালু হওয়া ছিল লীগের বড় সাফল্য।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরিবর্তন:
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি পায়।
যদিও প্রথমদিকে লীগের উদ্দেশ্য ছিল কেবল মুসলমানদের উন্নতি, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কার্যকলাপ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। এটি পরবর্তীকালে ভারতের ঐক্যকে দুর্বল করে তোলে।
ব্রিটিশ নীতিতে প্রভাব:
ব্রিটিশ সরকার শুরু থেকেই “Divide and Rule” বা “ফাটল ধরাও ও শাসন করো” নীতি অনুসরণ করছিল। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এই নীতিকে আরও কার্যকর করে তোলে। ব্রিটিশরা মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়।
ভারতীয় সংবিধানিক রাজনীতিতে ভূমিকা:
মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ভারতের সংবিধানিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার, ১৯১৬ সালের লখনৌ চুক্তি, এবং পরবর্তী বিভিন্ন সংস্কারে লীগের অংশগ্রহণ ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন পথে পরিচালিত করে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি:
মুসলিম লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো— এটি পরবর্তীকালে পাকিস্তান গঠনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব (Pakistan Resolution)-এর মাধ্যমে মুসলিম লীগ প্রথমবারের মতো স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজন ও পাকিস্তানের জন্ম মুসলিম লীগের নীতিরই ফলাফল।
ভারতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী প্রভাব:
মুসলিম লীগের কার্যকলাপের ফলে ভারতের রাজনীতিতে “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি”-এর সূচনা ঘটে।
এই ধারা পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করে।
উপসংহার:
সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ ভারতীয় ইতিহাসে এক জটিল অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এর প্রতিষ্ঠা মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিলেও, পরবর্তীকালে তা ভারতের ঐক্য ও জাতীয়তাবাদে বিভাজন সৃষ্টি করে। মুসলিম লীগের কার্যকলাপ একদিকে মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পথ খুলে দেয়, অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রকে চিরদিনের জন্য পরিবর্তন করে দেয়।
তবুও এটি নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে এক অনিবার্য অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।



Post Comment