×

লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০): মূল বক্তব্য, গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: Lahore Resolution (1940).

লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০): মূল বক্তব্য, গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: Lahore Resolution (1940).

ভূমিকা:

ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রথমবার ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলে। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আ. কে. ফজলুল হক প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই প্রস্তাবই “পাকিস্তান প্রস্তাব” নামে পরিচিত হয়।
এই প্রস্তাব ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অবসান ঘটিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং পরবর্তীতে ভারত বিভাজনের মূল কারণ হিসেবে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।

নিচে “লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য” সুন্দরভাবে ও বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো —

লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য (১৯৪০):

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশনে আ. কে. ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবটি ইতিহাসে “লাহোর প্রস্তাব” নামে পরিচিত। এই প্রস্তাব মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক দাবি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল বক্তব্য বা সারমর্ম নিচে তুলে ধরা হলো —

স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন (Independent States):

ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো—যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধ, বালোচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলা প্রভৃতি অঞ্চলকে একত্রিত করে “স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসমূহ” গঠন করতে হবে। এই রাষ্ট্রগুলির প্রশাসন হবে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত, যাতে তারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে।

অধিকার সংরক্ষণের নিশ্চয়তা:

প্রস্তাবে বলা হয়, এই নতুন রাষ্ট্রগুলিতে মুসলমানদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত থাকবে। অন্যদিকে, যেসব অঞ্চলে অমুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করবে, তাদেরও সম্পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ:

কোনো কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলির ওপর জোর করে নিয়ন্ত্রণ বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসন সম্পূর্ণভাবে বজায় থাকবে।

স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিশ্চিতকরণ:

প্রত্যেক প্রদেশের জনগণকে তাদের নিজস্ব সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে স্বশাসনের অধিকার দিতে হবে। এর মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখা হবে, যাতে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব (১৯৪০):

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই প্রস্তাব শুধু মুসলিম লিগের নীতিগত দিক পরিবর্তন করেনি, বরং ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এর ফলেই “পাকিস্তান আন্দোলন”-এর সূচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাজনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। নিচে প্রস্তাবটির প্রধান প্রধান গুরুত্বগুলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—

পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা:

লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রথমবার মুসলিম লীগ স্পষ্টভাবে ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলে। এটি ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই প্রস্তাবের পর থেকেই মুসলিম সমাজে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে এবং এই প্রস্তাবই পরবর্তীতে “পাকিস্তান প্রস্তাব” নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ঘটনার মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই ভিন্ন পথে বিভক্ত হয়ে যায়—একদিকে কংগ্রেসের ঐক্যবদ্ধ ভারত, অন্যদিকে মুসলিম লিগের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি।

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অবসান:

লাহোর প্রস্তাবের পর কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে
যেখানে একসময় উভয় দল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে অংশ নিত, সেখানে ১৯৪০ সালের পর থেকে তাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারণা ভেঙে পড়ে, এবং ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রস্তাব ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা:

লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ঘোষণা করে যে, মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে পৃথক এক জাতি (Nation)। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থ আলাদা, তাই একই রাষ্ট্রে তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। ফলে “এক দেশ – এক জাতি” ধারণার পরিবর্তে “দুই জাতি তত্ত্ব” দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তত্ত্বই পাকিস্তান গঠনের আদর্শ ভিত্তি হয়ে ওঠে এবং জিন্নাহ পরবর্তীতে এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত হন।

ব্রিটিশদের বিভাজন নীতিতে সহায়ক:

ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘদিন ধরেই “Divide and Rule” বা ভাগ করে শাসন করার নীতি অনুসরণ করছিল। লাহোর প্রস্তাব সেই নীতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ব্রিটিশ শাসকরা মুসলিম লিগের এই দাবিকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয় এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভেঙে ফেলে। ফলে ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে পড়ে।

ভারত বিভাজনের ভিত্তি স্থাপন:

লাহোর প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন
এই দাবিই পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
এর ফলেই ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়—ভারত ও পাকিস্তান। অতএব, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে ভারতের ইতিহাসে “বিভাজনের বীজ বপনের প্রস্তাব” বলা হয়।

উপসংহার:

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দলিল
এই প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি ভেঙে পড়ে এবং ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের পথ সুগম হয়। পরবর্তীকালে এই প্রস্তাবই পাকিস্তান সৃষ্টির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।
অতএব, লাহোর প্রস্তাবকে যথার্থভাবেই বলা যায়—
“ভারত বিভাজনের সূচনাপত্র” বা “পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর”

GSschool.in হল স্কুলভিত্তিক পড়াশোনার জন্য একটি সহায়ক ওয়েবসাইট। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এম.এ করেছি এবং শিক্ষকতায় যুক্ত আছি। এখানে স্কুল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নোটস, প্রশ্নপত্র, এবং পড়াশোনার টিপস দেওয়া হয়।

Previous post

মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন (১৯০৯): morley-minto-reform-act-1909-bangla.

Next post

ভারতীয় অর্থনীতির উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কীরূপ প্রভাব পড়েছিল? অথবা, ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল? Economic impact of World War I on India.

Post Comment

error: Content is protected !!