মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন (১৯০৯): morley-minto-reform-act-1909-bangla.
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকারের উপর ভারতীয়দের প্রশাসনিক অংশগ্রহণের দাবি জোরালো হয়। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় রাজনীতিতে কিছু সংস্কার আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারত সচিব লর্ড মর্লে এবং ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টো–র উদ্যোগে প্রণীত হয় মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন। এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের প্রশাসনে সীমিত অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হলেও, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের চাপ প্রশমিত করা ও ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরও মজবুত করা। এই আইন ভারতীয় প্রশাসনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে, কারণ এতে প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের জন্য আইনসভায় প্রবেশের সুযোগ এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রবর্তন করা হয়।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলী:
বিধান পরিষদের সম্প্রসারণ:
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলির সদস্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে আরও বেশি ভারতীয় শিক্ষিত ও জমিদার শ্রেণির মানুষ এই পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হতে পারতেন এবং নীতি-নির্ধারণে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন।
সীমিত ক্ষমতা:
বিধান পরিষদের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র পরামর্শমূলক ছিল। প্রকৃত প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে রয়ে যায়। অর্থাৎ আইন প্রণয়ন বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভারতীয় সদস্যদের প্রভাব ছিল সীমিত।
ভারতীয় সদস্য নিয়োগ:
প্রথমবারের মতো ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে একজন ভারতীয় সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০৯ সালে সৈয়দ হুসেন সুহরাওয়ার্দী এই পদে নিযুক্ত হন। এটি ভারতীয়দের প্রশাসনে সীমিত হলেও সক্রিয় অংশগ্রহণের পথ খুলেছিল।
পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা (Separate Electorate):
মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা নির্বাচনী আসন স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ মুসলমান প্রার্থীদের নির্বাচন কেবল মুসলমান ভোটাররা করতে পারতেন। এই বিধান ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের সূচনা করেছিল।
ভোটাধিকার সীমাবদ্ধতা:
ভোটাধিকার শুধুমাত্র জমিদার, শিক্ষিত এবং করদাতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ জনসাধারণ বা শ্রমিক, কৃষকদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়নি। ফলে এটি ভারতের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে সীমিত রাখে।
প্রশ্ন ও প্রস্তাবের অধিকার:
বিধান পরিষদের সদস্যরা সরকারের নীতি এবং বাজেট সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করার এবং প্রস্তাব জমা দেওয়ার অধিকার পান। তবে এই অধিকার সীমিত ছিল এবং সরকার সদস্যদের প্রস্তাব সবসময় গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রাখত না।
বাজেট আলোচনা:
সদস্যরা বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন এবং সরকারের নীতির সমালোচনা করতে পারতেন। তবে ভোটের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি। এটি পরিষদের ক্ষমতা সীমিত রাখার একটি মূল উপায় ছিল।
উপসংহার:
মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন (১৯০৯) ছিল ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই আইনের মাধ্যমে প্রথমবার ভারতীয়দের প্রশাসন ও আইন প্রণয়নের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও সেই অংশগ্রহণ ছিল সীমিত, তবুও এটি ভারতের রাজনৈতিক জাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
এই আইনের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যতের অধিক স্বাধীনতা ও স্বরাজ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি হয়। তবে এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক ছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন, যা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নষ্ট করে ব্রিটিশদের “Divide and Rule” নীতিকে আরও শক্তিশালী করে।
তবুও, ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই আইনটি ভারতের সাংবিধানিক বিকাশের প্রথম ধাপ হিসেবে স্বীকৃত। এর মাধ্যমে প্রশাসনে ভারতীয়দের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা আরও সুসংহত হয়। তাই বলা যায়, মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ছিল ভারতের স্বাধীনতার পথের প্রাথমিক প্রস্তুতি।



Post Comment