×

নব্য রাজতন্ত্র ও টমাস ক্রমওয়েলের অবদান: thomas-cromwell-reforms-new-monarchy-england.

নব্য রাজতন্ত্র ও টমাস ক্রমওয়েলের অবদান: thomas-cromwell-reforms-new-monarchy-england.

ভূমিকা:

ইউরোপের মধ্যযুগের শেষভাগে যখন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হতে শুরু করে, তখন ইউরোপে এক নতুন ধরনের রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে, যাকে বলা হয় নব্য রাজতন্ত্র (New Monarchy)। এই শাসনব্যবস্থায় রাজারা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে নিজের হাতে প্রশাসনিক, সামরিক ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নেন। ইংল্যান্ডে এই নব্য রাজতন্ত্রের বিকাশে টমাস ক্রমওয়েল (Thomas Cromwell)-এর অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নব্য রাজতন্ত্র কী?

‘নব্য রাজতন্ত্র’ বলতে বোঝানো হয় এমন এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে রাজা সামন্তশক্তিকে দুর্বল করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেন। মধ্যযুগের শেষদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনে এই ধরনের শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এটি মূলত রাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের প্রাথমিক রূপ, যার মাধ্যমে রাজা আইন, প্রশাসন, করব্যবস্থা ও ধর্মের ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।

নব্য রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:

  • রাজশক্তির কেন্দ্রীকরণ:
    রাজা সামন্তদের ক্ষমতা হ্রাস করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন।
  • স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন:
    রাজারা নিজেদের আনুগত্যশীল স্থায়ী সেনা গঠন করেন, যাতে যুদ্ধ ও নিরাপত্তায় সামন্তদের উপর নির্ভরতা কমে।
  • রাজস্ব ও করব্যবস্থার সংস্কার:
    রাজারা সরাসরি জনগণের কাছ থেকে কর আদায় শুরু করেন, ফলে রাজকোষ শক্তিশালী হয়।
  • চার্চের প্রভাব হ্রাস:
    ধর্মীয় কর্তৃত্বের পরিবর্তে রাজা নিজেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠেন।
  • আধুনিক প্রশাসনের সূচনা:
    শিক্ষা, আইন, বিচার ও প্রশাসনকে সংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক রূপ দেওয়া হয়।

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কার | Thomas Cromwell’s Reforms.

১৬শ শতাব্দীর ইউরোপে নব্য রাজতন্ত্র (New Monarchy) প্রতিষ্ঠার যুগে ইংল্যান্ডে রাজা অষ্টম হেনরির অন্যতম মন্ত্রী টমাস ক্রমওয়েল (Thomas Cromwell) ছিলেন এক অসামান্য সংগঠক ও সংস্কারক। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ইংরেজ রাজতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আধুনিক প্রশাসনিক রাষ্ট্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েলের ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী।

টমাস ক্রমওয়েলের জীবনী সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

টমাস ক্রমওয়েল জন্মগ্রহণ করেন প্রায় ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের একটি সাধারণ পরিবারে। জীবনের প্রথম দিকে তিনি ইতালি ও নেদারল্যান্ডে ব্যবসা ও আইনবিদ্যা শিখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে এসে রাজা অষ্টম হেনরির রাজসভায় প্রবেশ করেন। কার্ডিনাল উলসি পতনের পর ক্রমওয়েল রাজ্যের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন।

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারসমূহ:

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার:

টমাস ক্রমওয়েল রাজশক্তি সুদৃঢ় করার জন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তিনি “Privy Council” বা গোপন পরিষদ গঠন করেন, যেখানে রাজকার্য পরিচালনা আরও দ্রুত ও দক্ষ হয়। রাজকোষ বা “Royal Treasury” পুনর্গঠন করে রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আনেন।

ধর্মীয় সংস্কার:

ক্রমওয়েলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ইংরেজ ধর্মসংস্কার আন্দোলন (English Reformation)-এ। তিনি রাজা অষ্টম হেনরিকে পোপের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করে Church of England প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এর ফলে ইংল্যান্ডে রাজার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব একত্রিত হয়।

মঠ বিলুপ্তিকরণ (Dissolution of Monasteries):

১৫৩৬ থেকে ১৫৩৯ সালের মধ্যে টমাস ক্রমওয়েল দেশের বহু মঠ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করেন। এসব মঠের বিপুল সম্পত্তি রাজকোষে যুক্ত হয়, যা রাজশক্তি আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

সংসদ ও আইনি সংস্কার:

তিনি পার্লামেন্টের কার্যক্রমে রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। “Reformation Parliament” গঠনের মাধ্যমে রাজা অষ্টম হেনরিকে ‘Supreme Head of the Church’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়া আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক বিচারব্যবস্থায় নিয়মশৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নেন।

সামাজিক ও প্রশাসনিক সংগঠন:

ক্রমওয়েল স্থানীয় প্রশাসনেও পরিবর্তন আনেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে Justices of Peace বা শান্তিরক্ষী কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন, যারা রাজকীয় আইন কার্যকর করতেন। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব গ্রামীণ সমাজেও বিস্তৃত হয়।

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারের ফলাফল ও গুরুত্ব:

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারের ফলে ইংল্যান্ডে রাজশক্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তাঁর প্রশাসনিক কাঠামো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। মঠের সম্পদ রাজকোষে যুক্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে, এবং জনগণের মধ্যে রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতি নতুন ধারণা জন্ম নেয়।

তবে ক্রমওয়েলের কঠোর নীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে তিনি বহু শত্রু অর্জন করেন। ১৫৪০ সালে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

উপসংহার:

টমাস ক্রমওয়েল ছিলেন এক দূরদর্শী সংস্কারক, যিনি ইংরেজ রাজনীতিতে আধুনিকতার সূচনা ঘটান। তাঁর প্রশাসনিক ও ধর্মীয় সংস্কারই পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। তাই ইতিহাসে টমাস ক্রমওয়েলকে “ইংরেজ নব্য রাজতন্ত্রের স্থপতি” (Architect of the Tudor Monarchy) বলা হয়।

GSschool.in হল স্কুলভিত্তিক পড়াশোনার জন্য একটি সহায়ক ওয়েবসাইট। আমি সুকান্ত দাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এম.এ করেছি এবং শিক্ষকতায় যুক্ত আছি। এখানে স্কুল স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নোটস, প্রশ্নপত্র, এবং পড়াশোনার টিপস দেওয়া হয়।

Post Comment

error: Content is protected !!